গভীর রাতে মুহুর্মুহু গুলী, বোমা বিস্ফোরণ আর আর্তচিৎকারে ধরমড়িয়ে জেগে উঠলাম। বাচ্চারা আতঙ্কিত, বাচ্চার মা ভীত-সন্ত্রস্ত গলায় বলল, দেশে কি যুদ্ধ লেগে গেছে! আমি কি করব বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে ফোন দিলাম। আন রিচেবল রিপ্লাই পেলাম। আরেক জনকে রিং করলাম এক-দুই-তিন চতুর্থবারে সে ধরল। বললাম এত রাতে তারা কিছু শুনতে পাচ্ছে কিনা? সে অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে বলল, দেশে কি যুদ্ধ লেগে গেল! টিভি দেখে বলল, ঢাকা নগরীতে সরকারী বাহিনীর অভিযান চলছে। হেফাজতে ইসলামীকে তাদের অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে এভাবে গুলী ও বোমা-গ্রেনেড চার্জ করছে নিরাপত্তা বাহিনী।
ক্রমশ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলী এসে ঘরে পড়ে। চারদিকে খই ফোটার মত গুলীর শব্দ। সাথে মুহুর্মূহু গ্রেনেড ফাটছে। আর আর্তচিৎকারের সাথে মাইকের গগনবিদারী শব্দে আমরা চরম আতঙ্কিত। বাচ্চারা পরস্পর জড়াজড়ি করে বসে আছে আর ক্ষণে ক্ষণে বোমার শব্দে কেপে উঠছে।
ধীরে ধীরে চারদিক শান্ত হয়ে এল। মাঝে মাঝে গুলীর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে ৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে ফিরে এসেছি। জানালা দিয়ে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়েছিলাম। সেদিকে আগুনের লেলিহান শিখা আর হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানী রাতের কালো আকাশ চিরে উঠে যাচ্ছিল। আমরা পাথরের মত ভাষাহীন হয়ে বসে আছি। জানিনা আসলে কী ঘটে চলেছে সেখানে।
সকালে কিছু টাকার খুব দরকার হবে। কার্ড দিয়ে এ কাজ সামলাই। কিন্তু আজ এই পরিস্থিতিতে কী করব ভেবে পাচ্ছি না।
ভোর সাড়ে চারটায় এক প্রকার জীবনের ঝুকি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মতিঝিলের দিকে যাব, যা থাকে কপালে! মৌচাকের আগেই রাস্তায় হেফাজতের আলেম-উলামা আর ছাত্রদের অবিরাম হেটে চলার মিছিল দেখলাম। রাস্তায় কোন গাড়ী নেই। চারদিকে আগুনে পোড়া ধ্বংসাবশেষ। ট্রাফিক বক্সগুলো পুড়ে কংকাল হয়ে আছে। বাতাসে পোড়া গন্ধ এবং ছাই উড়ছে।
মালিবাগ মোড়ে চারদিকে ইট-পাথর আর সান্ডেল ছড়িয়ে আছে। আশ-পাশে টং দোকান আর ভ্যান দোকান উল্টে পড়ে আছে। তাতে আগুনে পোড়া আর গুলীর ক্ষত চিহ্ন। শান্তিনগর মোড়েও একই অবস্থা। ট্রাফিক বক্স ভস্মীভুত, পোড়া ধাতব ট্রাফিক ছাতা রাস্তার মাঝখানে উল্টে আছে। দলবেধে হেফাজতের লোকেরা শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে হেটে চলেছে। কিছু উৎসুক জনতা ভয়ার্ত চোখে এদিক সেদিক হাটছে। কাকরাইল মোড়ে গিয়ে মনে হল যুদ্ধের ময়দানেএসে পড়েছি। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে অনেক লোকঅধিকাংশ হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ রক্তাক্ত কাপড়। এদের ভেতর গ্রাম থেকে আসা শীর্ণ দেহের বৃদ্ধ থেকে কিশোর মাদ্রাসা ছাত্র রয়েছে বেশি। একেবারে সাদামাটা গায়ের লোক, যাকে বলে অরিজিনাল মাস পিপল। হঠাৎ বৃষ্টি, মটরবাইকটা ঘুরিয়ে হাসপাতালের ভেতর ঢুকলাম। আহত গুলীবিদ্ধ লোক আসছে। হাসপাতালের এক সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম কত লোক এখানে আহত এসেছে, নিহত কতজন? সে আমার পরিচয় জানতে চাইল। তারপর এক স্টাফের কাছে নিয়ে গেল। সাথে ক্যামেরা নিয়েছিলাম। স্টাফ আমাকে বলল, হাজার হাজার আহত এখানে এসেছে এবং কম আহতরা চিকিৎসা নিয়ে চলে যাচ্ছে। ভেতরে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে উপরের তলাগুলোয় আহতদের ভীড়ে উপচে পড়ছে। ভেতরের চত্বরে রক্তমাখা পাঞ্জাবি-লুঙ্গী ছড়িয়ে আছে। কোথাও আধপোড়া হাজি রুমাল পড়ে আছে। রীতিমত গণহত্যার চিহ্ন মনে হচ্ছে। লাশ ঘরে দুটো লাশ। এর একটা কিশোর। হিমঘরে আরো দুটো লাশ। একজনকে দেখে মধ্যবয়সী কোনো এক মাদ্রাসা শিক্ষকের মত মনে হয়। যিনি লাশ দেখাচ্ছিলেন, তিনি বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন আর বিড়বিড় করে বলছিলেন, আল্লাহ..আল্লাহ..
আমাকে দোতলায় নিয়ে একটি ঘরে আরেকটি লাশ দেখালেন। একেও একজন আলিম মনে হল। আমি আরো আছে কিনা জানতে চাইলে বললেন, এখানে ছয়টি লাশ আনা হয়। একটি লাশ নিয়ে গেছেস্বজনরা। বাকীরা অজ্ঞাত পরিচয়। তিনি আরো জানালেন কয়েক জনকে মুমুর্ষ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে এখান থেকে। তাদের বেচে থাকার ব্যাপারে তিনি কোন আশা দেখছেন না। এখানে একটি লাশের মাথায় দেহে চাপাতি-কিরিচের গভীর কোপের চিহ্ন রয়েছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে তিনি বললেন, তিনি শুনেছেন শাহজানপুর তাদের হাসপাতালে চারটি এবং খিদমাহ হাসপাতালে ছয়টি লাশ নেয়া হয়েছে।
কাকরাইল থেকে পল্টন হয়ে ঢাকা মেডিকেল যাচ্ছি। বিজয়নগর রাস্তায় আইল্যান্ডেরবড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাখা। দিগন্ত টিভির সামনে একুশে টিভি আর ২৪টিভির গাড়ী। জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর? ক্ষুব্ধকন্ঠে এক টিভি রিপোর্টার বললেন, রাতে দিগন্ত টিভির লোকদের সাথে যা করা হয়েছে, তা কল্পনাতীত। তারা তো অসত্য কিছুপ্রচার করেনি, কিন্তু কোন অজুহাতছাড়াই রাত ৪টা ২০ মিনিটে দিগন্তের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এর সাথে ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধের কথাও তিনি জানালেন।
পল্টন মোড়ে সচিবালয় ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান। বামে পুরো এলাকা আগুনেপোড়া আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। এর মধ্যেও হুজুর আর মাদ্রাসা ছাত্রদের বিক্ষিপ্ত চলাচল। গুলিস্তান হয়ে নিমতলী দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ঢুকলাম। ইমারজেন্সী ও ক্যাজুয়ালটি কমপ্লেক্সের সামনে সাংবাদিক জটলা। এ্যাম্বুলেন্স আর সিএনজি করে আহতদের আনা হচ্ছে। দায়িত্বরত সার্জন ডাক্তার-স্টাফদের নিয়ে আহতদের চিকিৎসা দিতে দৌড়ঝাপ করছেন। ভেতরে জরুরী মর্গেদুটো লাশ। প্রতিটি কক্ষে আহতদের ভীড়। সেখানে সাতটি লাশ এসেছেবলল এক স্টাফ। আরেক বয়স্ক স্টাফ বললেন ১১টি লাশ এসেছে। এ দুটো লাশ ছাড়া বাকীগুলোরকথা তিনি জানাতে অপারগতা জানালেন। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে। ঘুরে ঘুরে আহতদের দেখছি। মারাত্নক আহত আছে কয়েকজন। ডাক্তাররা অপরেশন চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে প্রায় সবই গুলীবিদ্ধ।
বৃষ্টি থেমে গেছে। শাহজানপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। গুলিস্তান হয়ে দিলকুশার ভেতর শাপলা চত্ত্বর আসলাম। শতশত নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ী। চারদিকে ধ্বংসস্তুপ। সিটি কর্পোরেশনের গাড়ীগুলোতে পোড়া আর জঞ্জাল তোলা হচ্ছে। হোশ পাইপ দিয়ে রাস্তার রক্ত ধুয়ে ফেলা হচ্ছে। নটরডেমের কাছে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন, আধার থাকতে থাকতে ময়লার গাড়ীতে করে বহু লাশ সরিয়ে নিতে দেখেছেন তিনি। রেব আর বিজিবির গাড়ী সারিবদ্ধ দাড় করা। তখন সকাল হয়ে গেছে। অভিযান শেষ। সবাই পরোটা দিয়ে নাস্তা করছেন।
শাহজানপুরের হাসপাতালে এসে দেখি সিএনজি থেকে আহতদের নামানো হচ্ছে। সিএনজি চালক ভাড়া না নিয়ে হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। আল্লাহ..তোমার নবীরজন্য যারা এই জীবনের মায়া ত্যাগ করে আহত-নিহত হল। তুমি এর উচিত জবাব দেও। আল্লাহ..এই নির্যাতনের শাস্তি দিয়ে আমাদের পরাণ শান্ত কর...
ভেতরে এক স্টাফ বললেন,ছয় লাশ এসেছিল, তাদের আবার শাপলা চত্ত্বর পাঠানো হয়েছে। আরেক স্টাফ বিভিন্ন রকমের ও সাইজের গুলি দেখালেন। যেগুলো অপারেশন করে বের করা হয়েছে। এখানেও বৃদ্ধ-তরুণ গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত আহতদের ভীড়। এসব দেখে আমার অস্বস্থি বাড়তে লাগল।
সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে এলাম। .....
- Get link
- X
- Other Apps
- Get link
- X
- Other Apps
Comments