পর্ব দুই
৮০ দশকের শেষ দিকের ঘটনা। শিশু একাডেমিতে মহাসমারোহে ছবি আকা আর সংস্কৃতিচর্চায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করি। স্যার ইকবাল রোডের ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও কেরাত-হামদ-নাত ইত্যাদি অনুষ্ঠান বাদ যায় না। শিশু একাডেমি ছিল পাইওনিয়ার গার্লস স্কুলের পাশে পুরাতন একটা ভবনে। পরে সেটা সোনাডাঙায় নিজস্ব ভবনে চলে যায়। খুলনা গল্লামারিতে তখন চারুকলা মাত্র শুরু হয়েছে। সেই চারুকলার অধ্যক্ষ আবুল কাশেম স্যার ছিলেন আমাদের আর্টের শিক্ষক। অবশ্য এর আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিয়ান জামান স্যার আমাদের ছবি আকা শেখাতেন। জামান স্যার অ্যামেচার আর্টিস্ট ছিলেন। তাই আমাদের ছবিতে একটা ফোক ভাব থাকত। পারস্পেকটিভ, প্রোপোরশন ইত্যাদি ঠিক হত না। কাশেম স্যার এসে সেগুলো ঠিক করে দিলেন। ব্যস, আমাদের উন্নতি হল দেখার মত । যেখানে প্রতিযোগিতা, সেখানে বিজয় আর পুরস্কার লাভ করা ডাল-ভাত হয়ে গেল।
একবার বরিশালে আন্ত:বিভাগ প্রতিযোগিতায় পেন্সিলস্কেচে বিভাগীয় পর্যায় কোয়ালিফাই করলাম। তখন অবশ্য জামান স্যার ছিলেন। ফলে প্রতিযোগিতায় দেয়া বিষয় আকতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। জামান স্যার আমাদের ছোট কাগজে ছবি আকা শেখাতেন, সেটা এ-৪ সাইজ ছিল। আর খুলনার প্রতিযোগিতায় কাগজ সর্বোচ্চ ১৫x২০ সাইজের হত, মানে হাফ সিট কার্টিস পেপার। কিন্তু বরিশালে প্রতিযোগিতায় দিল ফুল সিট, মানে ২০x৩০ সাইজের কার্টিস পেপার। এত বড় কাগজে আকার অভিজ্ঞতা নেই। তাই বলে রণে হাল ছাড়লাম না। কাগজের ভেতর হাফ সাইজের একটা বর্ডার একে তার ভেতর ছবি আকা শুরু করলাম। বিচারক আমার সমস্যাটা ধরে ফেলেছিলেন আর আমার ছবিতে ফোক ভাব থাকার পরেও সৃজনশীলতা ছিল বেশ। তিনি আমাকে বিচারের সময় ডাকলেন। বললেন, দেখো তোমার আকা ছবিতে এই এই সমস্যা আছে। তোমার শিক্ষক নিশ্চয়ই অ্যামেচার। যদি পারো.. চারুকলার ওস্তাদের কাছে শিখে নিও..তারপর কতগুলো বিষয় দেখালেন আর আফসোস করে বললেন, আসলে তোমার আকায় এই সমস্যাগুলো না থাকলে তুমি প্রথম হতে.... তারপর খুলনা ফিরে কাশেম স্যারকে আমরা ওস্তাদ হিসেবে পাই।
আমার সাংস্কৃতিক পরিসর বড় হতে লাগল। একবার খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় সিনিয়র ভাইরা দেয়ালিকা বানালেন। সেখানে জুনিয়রদের ঠাই হল না। আমি তখন সেভেনের ছাত্র। জিদ করে এক রাতের মধ্যে জুনিয়রদের লেখা নিয়ে ‘নবীন ঊষা’ শিরোনামে দেয়ালিকা বানিয়ে রুমে সামনে টানিয়ে দিলাম। ব্যস, হইচই পড়ে গেল। বড় ভাইরা বোর্ডিং সুপারের কাছে নালিশ দিল। বোর্ডিং সুপারের চোখে এটা বড়দের সাথে বেয়াদবি আর পড়া-শুনার ক্ষতি বিবেচনায় বেতের বাড়ি খেলাম দুপুরের ভাত খাওয়ার আগে আর দেয়ালিকা বাজেয়াপ্ত হল। কিন্তু আছরের পর প্রিন্সিপ্যাল সালেহ ওস্তাদ মাদ্রাসায় এসে সব শুনে বোর্ডিং সুপারকে তলব করে শাসিয়ে দিলেন আর আমাকে ডেকে দেয়ালিকা ফেরত দিয়ে হাতের লেখার প্রশংসা করলেন এবং শিশু একাডেমির মৌসুমি দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতার একটা সার্কুলার দিলেন। প্রতিযোগিতায় ভালভাবে অংশ নেয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতে ৫০০টাকা দিলেন।
তখন ছিল ভর বর্ষার মওসুম। প্রিন্সিপ্যাল ওস্তাদের ছেলে মাসুম, মাদানি হুজুরের ভাতিজা আবু সাঈদ আর আমি রাত-দিন পরিশ্রম করে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পত্রিকা দাড় করিয়ে ফেললাম। মাদরাসার সবাই খুব গুনগান করল... ইনশা আল্লাহ পুরস্কার আমরা পাবোই...
আমাকে দেয়ালিকার সম্পাদক করা হল। পত্রিকার নাম ‘শাওন’ রাখা হল। নাম প্রস্তাব করে ছিল আবু সাঈদ। খুলনা বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে ঢাকার শিশু একাডেমিতে আসলাম। পত্রিকা বাসের ছাদে নেয়ায় ঘসে একজায়গায় কাগজ নস্ট হয়। ফলে প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার অর্জন করি।
বি. দ্র- দেয়ালিকার সামনে পোজ দিয়ে ভাব নিতে দেখা যাচ্ছে সম্পাদককে!
- Get link
- X
- Other Apps
- Get link
- X
- Other Apps
Comments