খুলনা শহরের শান্ত নিরিবিলি এলাকা টুটপাড়ায় আমার শৈশবের দিনগুলো হেসে-খেলে গুজরান করেছি। তখনকার মনে দাগকাটা স্মৃতিগুলো সময়ে-অসময়ে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। আমাদের পাড়ায় যে বিশালায়তনের কবরখানাটি আছে। সেটা খুলনা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিচিত্র রূপে বাধানো সেখানকার কবরগুলো। নতুন আর পুরাতন অংশ দক্ষিণ-উত্তরে বিভক্ত। বিচিত্র রঙ আর ধরণের ফুলে ভরা পুরা কবরগাহ। প্রতি শবে-বরাত আর শবে-কদরের রাতে হাজার হাজার মানুষ সেখানে জিয়ারতের জন্য আসে। বিশেষকরে শবে-বরাত আসলেই সারা শহরে যেন একটা পবিত্র আবেশ ছড়িয়ে পড়ত। দলে দলে লোকেরা পান্জাবি-টুপি পরে মসজিদে ভরে যেত। আসরের পর মিলাদ-দোয়ার অনুষ্ঠান হত। ঘরে ঘরে রুটি-হালুয়া তৈরি হত। গ্রাম থেকে কেউ আসলে বলত- রুটির দিন। সেইদিন আচানকভাবে ভিক্ষুকে ভরে যেত শহর। মনে হত আসমান থেকে সব আজব চেহারা আর পোশাক, ঝোলা-পাত্র, লাল সুতায় মোড়ানো লাঠি নিয়ে ভিক্ষুকেরা নেমে এসেছে। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে আকর্ষণীয় সুরে এবং বিভিন্ন ভাষায় রুটি-হালুয়ার আবেদন করছে, মা-চাচিরা সেইদিন দিল উজাড় করে খাবার দান করতেন। আর তশতরিতে নকশাদার কাপড়ে ঢেকে নানান পদের হালুয়া-ফিরনি আর চালের আটার পাতলা রুটি প্রতিবেশিদের ঘরে পৌছে দিত ছোটরা। দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই বিলি-বন্টন চলত। তারপর ঘরের মহিলারা গোসল সেরে ইবাদাতে মগ্ন হতেন। আমরা শিশুরা জামা-টুপি লাগিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম। তবে সবচেয়ে অবাক হতাম সন্ধ্যার পর কবরখানার দু’পাশের রাস্তায় বহুদূর পর্যন্ত ভিক্ষুকদের কুপি জ্বালিয়ে লাইন করে বসে ভিক্ষা চাওয়া দেখে। তারা দিনের বেলায় রাস্তায় রঙ দিয়ে, ইটের টুকরো দিয়ে দাগ কেটে, কখনও দাগকাটা ঘরের ভেতর তাদের নাম লিখে জায়গার দখল নিত। রাতে কুপির আলোয় তাদের চেহারা মলিন আর সকাতর দেখাত, কবর জিয়ারতে আসা মানুষেরা আত্মীয়-স্বজনের মাগফেরাত কামনায় অকাতরে দান করতেন। মনে পড়ে এক শবে-বরাতের ফজরের পর মসজিদ থেকে ফিরে বড় চাচা আমাকে নিয়ে কবরগাহে গেলেন। আব্বা তখন বাড়িতে ছিলেন না। কবরখানায় নি:শব্দে যেন ঘুমিয়ে আছে লাশেরা.. চারদিক সুনসান.. ভিক্ষুকেরা ফিরে গেছে তাদের ডেরায়.. শুধু টুপটাপ ঝরে পড়ছে শীতের ভোরের শিশির...কয়েকজন মাত্র মুসল্লি এখানে সেখানে দাড়িয়ে জিয়ারত করছে... আমরা কবরগাহের ভেতরে খালি পায়ে ঢুকলাম... তিনি উত্তর পাশের একটি জীর্ণ কবর দেখিয়ে বললেন, এইটা তোমার দাদীর কবর! তারপাশে আরেকটি কবর দেখিয়ে বললেন, এইটা তোমার মায়ের! আসো আমরা আমাদের মায়ের জন্য দুআ করি.... দু’হাত তুলতেই আমার বুক ভেঙ্গে এল !... বড়চা তখন কেদে চলেছেন !.. রব্বের হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা....
খুলনা শহরের শান্ত নিরিবিলি এলাকা টুটপাড়ায় আমার শৈশবের দিনগুলো হেসে-খেলে গুজরান করেছি। তখনকার মনে দাগকাটা স্মৃতিগুলো সময়ে-অসময়ে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। আমাদের পাড়ায় যে বিশালায়তনের কবরখানাটি আছে। সেটা খুলনা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিচিত্র রূপে বাধানো সেখানকার কবরগুলো। নতুন আর পুরাতন অংশ দক্ষিণ-উত্তরে বিভক্ত। বিচিত্র রঙ আর ধরণের ফুলে ভরা পুরা কবরগাহ। প্রতি শবে-বরাত আর শবে-কদরের রাতে হাজার হাজার মানুষ সেখানে জিয়ারতের জন্য আসে। বিশেষকরে শবে-বরাত আসলেই সারা শহরে যেন একটা পবিত্র আবেশ ছড়িয়ে পড়ত। দলে দলে লোকেরা পান্জাবি-টুপি পরে মসজিদে ভরে যেত। আসরের পর মিলাদ-দোয়ার অনুষ্ঠান হত। ঘরে ঘরে রুটি-হালুয়া তৈরি হত। গ্রাম থেকে কেউ আসলে বলত- রুটির দিন। সেইদিন আচানকভাবে ভিক্ষুকে ভরে যেত শহর। মনে হত আসমান থেকে সব আজব চেহারা আর পোশাক, ঝোলা-পাত্র, লাল সুতায় মোড়ানো লাঠি নিয়ে ভিক্ষুকেরা নেমে এসেছে। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে আকর্ষণীয় সুরে এবং বিভিন্ন ভাষায় রুটি-হালুয়ার আবেদন করছে, মা-চাচিরা সেইদিন দিল উজাড় করে খাবার দান করতেন। আর তশতরিতে নকশাদার কাপড়ে ঢেকে নানান পদের হালুয়া-ফিরনি আর চালের আটার পাতলা রুটি প্রতিবেশিদের ঘরে পৌছে দিত ছোটরা। দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই বিলি-বন্টন চলত। তারপর ঘরের মহিলারা গোসল সেরে ইবাদাতে মগ্ন হতেন। আমরা শিশুরা জামা-টুপি লাগিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম। তবে সবচেয়ে অবাক হতাম সন্ধ্যার পর কবরখানার দু’পাশের রাস্তায় বহুদূর পর্যন্ত ভিক্ষুকদের কুপি জ্বালিয়ে লাইন করে বসে ভিক্ষা চাওয়া দেখে। তারা দিনের বেলায় রাস্তায় রঙ দিয়ে, ইটের টুকরো দিয়ে দাগ কেটে, কখনও দাগকাটা ঘরের ভেতর তাদের নাম লিখে জায়গার দখল নিত। রাতে কুপির আলোয় তাদের চেহারা মলিন আর সকাতর দেখাত, কবর জিয়ারতে আসা মানুষেরা আত্মীয়-স্বজনের মাগফেরাত কামনায় অকাতরে দান করতেন। মনে পড়ে এক শবে-বরাতের ফজরের পর মসজিদ থেকে ফিরে বড় চাচা আমাকে নিয়ে কবরগাহে গেলেন। আব্বা তখন বাড়িতে ছিলেন না। কবরখানায় নি:শব্দে যেন ঘুমিয়ে আছে লাশেরা.. চারদিক সুনসান.. ভিক্ষুকেরা ফিরে গেছে তাদের ডেরায়.. শুধু টুপটাপ ঝরে পড়ছে শীতের ভোরের শিশির...কয়েকজন মাত্র মুসল্লি এখানে সেখানে দাড়িয়ে জিয়ারত করছে... আমরা কবরগাহের ভেতরে খালি পায়ে ঢুকলাম... তিনি উত্তর পাশের একটি জীর্ণ কবর দেখিয়ে বললেন, এইটা তোমার দাদীর কবর! তারপাশে আরেকটি কবর দেখিয়ে বললেন, এইটা তোমার মায়ের! আসো আমরা আমাদের মায়ের জন্য দুআ করি.... দু’হাত তুলতেই আমার বুক ভেঙ্গে এল !... বড়চা তখন কেদে চলেছেন !.. রব্বের হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা....
Comments